-সম্পাদকীয়’, ‘খোলা কলাম’ বা ‘মুক্ত চিন্তা’ জাতীয় বিভিন্ন শিরোনামে বিভিন্ন পত্রিকা দেশের সমসাময়িক বিষয়ে অভিজ্ঞ ও স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের মতামত/বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। তবে যে শিরোনামই ব্যবহার করা হোক না কেন, সাধারণ পাঠক এসব কলাম লেখকদের কাছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য ও যুক্তি নির্ভর এবং বিশেষজ্ঞ মতামতই প্রত্যাশা করে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, কখনো কখনো আমাদের দেশের কলাম লেখকরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা বা গবেষণা না করে, মনগড়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের মতবাদকে সাধারণ পাঠকের উপরে চাপিয়ে দেন। তাদের এসব মতামত/বিশ্লেষণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে যৌক্তিক হলেও পাঠকের সরল বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে মনগড়া তথ্য ব্যবহার করাটি কাঙ্ক্ষিত নয়। এ রকমই দুই একটি উদাহরণ নিয়েই আজকের এই লেখা।
দৈনিক প্রথমআলো পত্রিকায় ৩১ জানুয়ারি ২০১৩ এর সম্পাদকীয় বিভাগে “চাকরি খুঁজো না, চাকরি দাও” শিরোনামে একটি আর্টিকেল লিখেছেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান। লেখাটিতে বাংলাদেশে তরুনদের চাকরি না খুঁজে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে – খুবই ভাল, গঠনমূলক লেখা। তবে সমস্যাটি হলো, এই লেখার মধ্য তিনি না জেনে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন। তাঁর বক্তব্যের নিচের অংশটুকু দেখে নেই:
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করার পর সবাই নিজে একটা কিছু করার চেষ্টা করেন। কয়েকবার ফেল করার পর তাঁরা চাকরি করতে যান।
‘সবাই’ নিজে একটা কিছু করার চেষ্টা করেন – কথাটি অত্যন্ত দুর্বল যুক্তির। কারণ, যদি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীও থাকেন যিনি নিজে কিছু করার চেষ্টা না করে চাকরি করে থাকেন তাহলে মুনির হাসানের বক্তব্যটি অসাড় বলে প্রমাণিত হয়। কারও বক্তব্যের বাস্তব ভিত্তি থাকলেও অকাট্য প্রমাণ না থাকলে ‘সবাই’ জাতীয় শক্ত শব্দ ব্যবহার না করে ‘অধিকাংশ’ বা ‘বেশির ভাগ’ ধরনের শব্দের ব্যবহার করাই শ্রেয়।
আমেরিকার প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এন্ট্রাপ্রোনিউরশিপ নিয়ে কোর্স করানো হয় এ কথাটি সত্য হলেও হার্ভার্ড এমবিএ নিয়ে মুনীর হাসানের বক্তব্যটি মোটেও সঠিক নয়। তার বাস্তব প্রমাণ হচ্ছে, হার্ভার্ড এমবিএ নিয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা। আমাদের কোম্পানীতে (Anheuser Busch InBev), আমরা প্রতি বছরই হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে সদ্য এমবিএ শেষ করা শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দেয়ার জন্য ইন্টারভিউ নিয়ে থাকি এবং ফাইন্যান্স এবং মার্কেটিং বিভাগে কয়েকজনকে নিয়োগও দেয়া হয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়াও হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ক্যারিয়ার সেন্টারের দেয়া পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১২ সালে শেষ করা হার্ভার্ড এমবিএ ক্লাসের ২৫% গ্র্যাজুয়েট কনসাল্টিং সার্ভিস এবং ৩৫% গ্র্যাজুয়েট বিভিন্ন ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছেন, আর বাকিদের মধ্যেও বেশিরভাগই বিভিন্ন শিল্পে চাকরি নিয়েছেন। হার্ভার্ডের দেয়া এই তথ্যের ভিত্তিতে তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, হার্ভার্ডের প্রতিটি শিক্ষার্থীই কয়েকবার নিজে কিছু করতে গিয়ে ফেল করার পরেই চাকরি করতে যান বলে মুনির হাসানের মন্তব্যটি অত্যন্ত অতিরঞ্জিত। দেশের তরুণদের উদ্যোক্তা হতে আহবান জানানো অবশ্যই উৎসাহব্যঞ্জক এবং প্রাসঙ্গিক। তবে যৌক্তিক এই মতবাদ লিখতে গিয়ে নিজের ইচ্ছামত তথ্য সংযোজন করা দায়িত্বহীন।
উপরোক্ত ঘটনাটি মোটেই বিচ্ছিন্ন নয়। দেশের সম্মানিত আরও অনেকে এ ধরনের ভুল/বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করে মতামত লেখেন বিভিন্ন পত্রিকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান একবার আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণা ক্ষেত্রে অপ্রতুল বরাদ্দ সমন্ধে লিখতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ইন সেন্ট লুইস এবং জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি এর মধ্য তালগোল পাকিয়ে ফেললেন। শুধু তাই নয়, এক বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফান্ড এবং অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এনডাউমেন্ট ফান্ডের উদাহরণ টেনে যুক্তি উপস্থাপন করলেন। তিনি লিখলেন,
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় (Washington University in St. Louis) ২০০৬ অর্থনৈতিক বর্ষে গবেষণা করার জন্য ফেডারেল রিসার্চ ফান্ড থেকে ৪৩৪ মিলিয়ন ডলার লাভ করে। সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বার্ষিক বরাদ্দ (Endowment) হচ্ছে ১৪৪ কোটি সিঙ্গাপুর ডলার।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় আর ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ইন সেইন্ট লুইস যে আলাদা তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আর রিসার্চ ফান্ড ও এনডাউমেন্ট ফান্ডের তুলনা করা যে আপেলের সাথে কমলার তুলনা করার সমতুল্য সেটি যারা এই ফান্ডগুলোর ব্যবহারিক অর্থ জানেন তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। বাংলাদেশে যে গবেষণা ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই সে ব্যাপারে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন বলে মনে করি না। অন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালগুলোতে গবেষণা ফান্ডের দৈন্যদশা প্রমাণ করাও অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। তবে, সেই তুলনাটি যাতে সঠিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে হয় সেটি নিশ্চিত করা নিঃসন্দেহে লেখকের দায়িত্ব।
শেষ করার আগে বলতে চাই, পত্রিকায় মতামত প্রকাশের সময় একজন লেখকের অনেক সতর্ক হওয়া জরুরী। কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হলেও মতামত প্রকাশ করার আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণা/পড়াশোনা করে তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা উচিত। উপরোক্ত উদাহরণগুলোর উভয় ক্ষেত্রেই লেখকগণ তাদের এই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ইন্টারনেটের এই যুগে, গুগল সার্চ করে একটু পড়াশোনা করলেই তাঁরা প্রকৃত তথ্যের উপর ভিত্তি করে তাদের মতামতগুলো লিখতে পারতেন। উল্লেখিত আর্টিকেলগুলোতে ভুল তথ্য উপস্থাপনা সংশ্লিষ্ট লেখকদের পড়াশোনা/গবেষণা করার প্রতি অনীহাই প্রকাশ করে।